আজ, শুক্রবার | ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ভোর ৫:১৩

ব্রেকিং নিউজ :
শ্রীপুরে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী রাজন-সংগ্রামের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ জমে উঠেছে শ্রীপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন মাগুরায় জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উদযাপন বৃষ্টির প্রার্থনায় নামাজ পড়ে কাঁদলেন শ্রীপুরের মুসল্লিরা মহম্মদপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় শিক্ষকের মৃত্যু মাগুরায় প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ মাগুরায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন জাহিদুর রেজা চন্দন ও নবীব আলী মহম্মদপুরে চেয়ারম্যান পদে ৯ জন শালিখায় ৫ জনের মনোনয়ন পত্র জমা স্মৃতির আয়নায় প্রিয় শিক্ষক কাজী ফয়জুর রহমান স্মৃতির আয়নায় প্রিয় শিক্ষক কাজী ফয়জুর রহমান

ইউনুস থেকে বিন্দুবালা

অনন্যা হক : নাম মোহাম্মদ ইউনুস।
বাড়ি শ্রীপুর উপজেলার সারঙ্গদিয়া গ্রামে। সেখানে অভাবের সংসার তার।
বারো বছর বয়সে বাড়ি থেকে কাজের জন্য বের হতে হয় তাকে।
এ জীবন অন্য রকম!

পৃথিবীতে এক জীবনে বহু রঙ, বহু লীলা।
কে কোন রঙ মেখে, কোন লীলার শিকার হয়ে দুনিয়ার বুকে জন্ম নেয় তার কিছুই জানি না, নেই  কিছুই আমাদের হাতে।

আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনা। মাগুরা শহরের কোন একটি জায়গাতে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছে ইউনুস। বিষয়টি আমার আব্বার চোখে পড়ে। আব্বা তার কষ্টের কথা শুনে কলেজের মেসে তার কাজের সুযোগ করে দেন। আব্বা তখন মাগুরা সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। কলেজ মেসে কাজের সুযোগ পেয়ে ইউনুসও খুশি।

প্রথমে বেতন তার পঞ্চাশ টাকা ধার্য করা হয়। সেখানে সে রান্নাবান্না এবং সহযোগী সব কাজ করা শুরু করে। কাজে তার আন্তরিকতা দেখে প্রথম মাসেই বেতন পঞ্চাশ থেকে বাড়িয়ে তিনশত টাকা করে দেয়া হয়। আর এই এখান থেকেই শুরু ইউনুসের গল্প। এরপর আর থেমে থাকেনি সে। কেঁটে গেছে পঁয়ত্রিশটি বছর। এখনও কলেজ মেসেই আছে সে। তবে রান্না বান্নার পাশাপাশি মালির কাজও করছে।

ইউনুসের আরেকটি বিশেষত্ব সে একজন ভালো নৃত্যশিল্পী। রয়েছে তার একটি নাচের দলও। নিয়মিত কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে তার দল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মাগুরা এবং আশেপাশে শহর বা গ্রামে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সম্পূর্ণ নিজের রপ্ত করা নৃত্যকলা দেখিয়ে বাড়তি আয় করে। সেই টাকা দিয়ে সে নিজে চলে এবং পরিবারের যখন যার যেটি দরকার তা মিটিয়ে থাকে আন্তরিক ও দায়িত্বের সাথে।

এই নৃত্যের দলে ইউনুসের নাম বিন্দুবালা।
নাচের অনুষ্ঠানগুলোতে ইউনুস মেকআপের আড়ালে হয়ে যায় সম্পূর্ণ একজন নারী। একজন বিন্দুবালা। সে নিজেও নিজেকে একজন বহুরূপী বলে দাবি করে।

সত্যিই তার অনেক মেধা। নিখুঁত মেকআপ করে নিজেই। নাচের মুদ্রা-অভিনয় কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই সে উপস্থাপন করতে পারে সাবলিলভাবে। আর তার হাতের রান্নার প্রশংসা শহরের সবখানেই। ভালো রান্নার জন্যে বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়মিত ডাক পড়ে তার।

ইউনুস কোনো বিয়ে করেনি। নেই নিজের কোন সংসার। এটি তার ভাগ্যের ফের, নিয়তির লিখন। অনেক দিন ধরে আমরা তাকে চিনি। এবার বাড়িতে এলে কথা বলতে বলতে তার জীবনের অনেক কিছু জানতে পারি।

আমাদের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে বহু মানুষ। কতরকম জীবন তাদের, কতরকম কষ্ট। কত রকম আনন্দ, সুখ, বেদনা তাদের। আমরা কজন খোঁজ রাখি তার।

ইউনুস আমার আব্বার প্রতি বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ। এটি সব সময় আমাদের কাছে প্রকাশ করে। সেসব কথা বলতে গিয়ে চোখে পানি এসে যায় তার।

ও হিজড়া গোত্রে পড়ে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার মতো এমন আরো অনেক মানুষ।
ওরা আমাদের, এই মানুষ্য প্রজাতিরই একটা অংশ। কেবল জেনেটিক বিন্যাসের রকমফেরে তারা হিজড়া নামে একটা আলাদা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।

আমাদের এই মানুষের ভেতরেই অনেকে বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি না করে তাচ্ছিল্য, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ এমনকি উপহাসও করে থাকে। অথচ আমাদের মতো যে কোন পরিবারের সদস্যই অদৃশ্য শক্তির ঈশারাতেই এমন জীবনের শিকার হতে পারে। যেখানে তাদের কোন হাত নেই, যেখানে ভীষণ অসহায় তারা।

আবার অনেক মানুষ আছেন, যারা অনুভূতিপ্রবণ, বিষয়টি অন্তর দিয়ে অনুভব করেন, তারা তাদের কষ্টটিকে উপলব্ধি করতে পারেন। এটিই এখন আমাদের সমাজের মানুষের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, আলাদা চোখে না দেখে ওদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করা। আমাদের সরকার থেকেও প্রয়োজন তাদের জন্যে যথাযথ উদ্যোগ।

যোগ্যতার ভিত্তিতে কোন কাজের সুযোগ নেই বলেই পুরো দেশ জুড়ে এই হিজড়া শ্রেণী জীবনের প্রয়োজনে পথে ঘাটে হাটে বাজারে যত্রতত্র মানুষকে বিরক্ত করে। জোর করে অর্থ আদায় করে। অনেক সময় যেটি বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা অনেকে সময় দেই তাদের, আবার কখনও দেই না।

ওরা যথেষ্ট শক্ত সমর্থ। যথাযথ কাজের সুযোগের অভাবে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে এভাবেই। অথচ অনেকেই আছে যারা কাজ করে সন্মানের সাথে বাঁচতে চায়। আমাদের পরিচিত এই ইউনুস তেমনই একটা ছেলে, যে কাজ করতে চেয়েছিল এবং সেই সুযোগটি আমার আব্বা করে দিয়েছিলেন জেনে আমার মধ্যেও ভালোলাগা কাজ করে। আব্বার গভীর অনুভূতিশীল মন আমাকেও স্পর্শ করেছে।

মাগুরাতে ইউনুসের যে দলটি রয়েছে তারা কখনও কারো কাছ থেকে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অর্থ আদায় করেছে এমনটি শোনা যায়নি। বরং সে কলেজের কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রোগ্রামে নেচে এযাবৎকাল ধরে তার এবং তার পরিবারের দায়িত্ব সুন্দরভাবে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

আমরা মানুষ, ওরাও মানুষ এবং আল্লাহ’র সৃষ্টি বান্দা।
প্রকৃত মানুষ হিসেবে ওদের প্রতি আমাদের সহানুভূতিশীল থাকা অবশ্যই দায়িত্ব। সমাজের বিভিন্ন মানুষ, যাদের সামর্থ্য আছে এবং সরকারের এ বিষয়ে বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করা এবং পদক্ষেপ নেয়া সত্যি ভীষণ জরুরী।

ইউনুস চায় সরকারি কলেজে ওর কাজটি পাকাপাকিভাবে সরকারি চাকরির আওতাভুক্ত হোক। সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ বিষয়টি সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখবেন সেই প্রত্যাশা।

পরিস্থিতি,পরিবেশ, মানুষ ওদের সহায় হোক!
ইউনুস কখনও ইউনুস, কখনও বিন্দুবালা হয়ে
তবুও সহজ সুন্দর ভাবে,আনন্দের সাথে জীবন যাপন করে বেঁচে থাক।

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology